একজন অগ্রগামী ব্যাক্তি এবং একজন পিছিয়ে থাকা মানুষের মাঝে যে পার্থক্যটা সবার প্রথমেই নজরে আসে, সেটা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস ! মানুষ সবসময় নিজের ভালোর জন্য, ক্যারিয়ারের ভালোর জন্য একের পরে এক প্ল্যান প্রোগ্রাম করে। কিন্তু সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, মানুষ চেষ্টা করে ১-২ দিন অথবা সর্বোচ্চ ৩-৪ দিন। এরপর তাঁরা তাদের নিজের করা প্ল্যানটাই ভুলে বসে থাকে। আমাদের অনেক গুলো বিশিষ্টের মাঝে কিছু বিশিষ্ট খুবই আলাদা ধরনের, যেগুলো আসলে নিজের জন্যই খুবই বিপদজনক। এই বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষের নিজের ভেতরের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করার ব্যাপারে খুবই গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করে। আজকে আমরা আলোচনা করবো যে, একজন ব্যাক্তি নিজের কোন কোন বৈশিষ্ট্যের জন্য আত্মবিশ্বাসের জায়গায় চরম সন্দেহে ভোগে এবং নিজের উপরে বিশ্বাস না থাকার কারণে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ সম্ভাবনার জায়গায় নিজেকে নিয়ে যেতে পারে না। যে যে বৈশিষ্ট্যের কারণে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয় আমরা সেই বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করবো ইনশাল্লাহ।
এক-ইশ্বরবাদে বিশ্বাসী হিসাবে আমি নিজেও বিশ্বাস করি যে, মানুষকে আল্লাহ্ দুনিয়ার শাসক হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তাই মানুষের সফলতা আসলে আল্লাহ্ প্রদত্ত। তাই মানুষকে তার ভাগ্য গড়ার পুর্ন স্বাধীনতা আল্লাহ্ পাক দিয়েছেন এবং চেষ্টা করার পরে তাওয়াককুল করতে বলেছেন। তাই ধর্মিয় বিশ্বাস থেকে খুব সহজেই বলা যায়, মানুষ চাইলেই সফলতার পথে হাঁটতে পারে এবং আল্লাহ্ চান যে মানুষ সফলতার পথে হাঁটুক। কিন্তু সমস্যা আসলে আমাদের নিজেদের ভেতর। আমরা ছোটবেলা থেকেই খুব সহজ সরল তিনটা ট্র্যাপ-এ পরে নিজের সম্ভাব্য পটেনশিয়ালস ভুলে থাকি। চলুন দেখে নেয়া যাক সেই তিনটা ট্র্যাপঃ
১। মাইন্ড ট্র্যাপ
২। ওয়াটার ট্রেডিং
৩। ডেসটিনেশন অবসেশন
মাইন্ড ট্র্যাপঃ
ছোটবেলা থেকেই আমাদের এডুকেশন সিস্টেম আমাদেরকে কিছু অপ্রাসংগিক কথা শেখায়। বলেঃ যদি তুমি ভালোভাবে লেখাপড়া না করো, তাহলে তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার ! যদি তুমি পরীক্ষায় ভালো করতে চাও তবে তোমাকে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। এই প্রস্তুতির কোনো শেষ আছে কি ? না , নাই। আমাদের এডুকেশন সিস্টেম আসলে আমাদেরকে ভালো শ্রমিক হতে উদ্ভুদ্ধ করে। ৯টা ৫টা চাকুরী পাওয়ার পেছনে প্রস্তুতির কোনো শেষ নেই ! এই প্রস্তুতি নিতে নিতে জীবনের কিছুই আর উপভোগ করার সুযোগ নেই। এস এস সি পরীক্ষার আগে সবাই বলবে, কলেজে উঠে গেলেই আরাম । হায়ার সেকেন্ডারিতে এইস এস সি তে প্রথমে ভালো ফলাফল করতে হবে এবং পরে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই হবে, না হলে সম্মান শেষ, জীবন শেষ! কী বিচিত্র সব চিন্তা ভাবনা!
চিন্তাটা কেনো বিচিত্র সেটা কয়েকটি প্রশ্ন দিয়েই আপনি জাস্টিফাই করতে পারবেন। প্রশ্নটি হচ্ছঃ
– আচ্ছা কয়জন বিখ্যাত ব্যাক্তির নাম আপনি বলতে পারবেন যারা শুধুমাত্র ৯টা-৫টা চাকুরীজীবী ছিলেন ?
– আচ্ছা কয়জন সেলফ মেড বড়লোক দেখেছেন যারা ইনোভেশন/সার্ভিস/মেনুফেকচারিং বাদ দিয়ে শুধু মুখে টাকা চাই টাকা চাই করে অনেক টাকার মালিক হয়ে গেছে ? বরং দেখবেন যারা মুখে মুখে টাকা চাই টাকা চাই বলে বেড়ায়, তাঁরা আরো বেশী অভাবে পতিত হয়।
– কয়জন পৃথিবী বদলে দেয়া ব্যাক্তির নাম আপনি বলতে পারবেন যারা পরীক্ষায় সবসময় প্রথম হতো?
– কয়জন সফল ব্যাক্তি দেখেছেন যারা জীবনে কমপক্ষে ৪৯% জায়গায় ব্যার্থ হয় নাই ?
আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। মূল প্রসঙ্গে আসি। মাইন্ড ট্র্যাপ হচ্ছে চিন্তা করার ভুল প্রসেস। নীচে কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ দেয়া হলোঃ
১। ভবিষ্যৎবীদ হয়ে যাওয়াঃ
মাঝে মাঝেই অনেকের মনে হতে পারে যে,
– আমি কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলি, তাই আমাকে দিয়ে হবে না !
– আমার মানুষের সাথে কমিউনিকেশন স্কিল খারাপ, তাই মনে হয় প্রোমোশন হবে না !
– আমি কখনোই কোনো চ্যালেঞ্জ ওভারকাম করতে পারিনি , তাই মনে হয় এইবার-ও পারবো না !
– আমি যেই কাজেই হাত দেই, এমন সব ঝামেলা এসে যায়, আমার আর কিচ্ছু করার থাকে না !
যারা নিজের ব্যাপারে মাইন্ড ট্র্যাপে পরে আছে, তাঁরা আবার অন্যের বিষয়েও ভবিষ্যতবাণী করতে শুরু করে। যেমনঃ অমুকের কাজে মনোযোগ কম, তাই সে পারবে না ! ইত্যাদি ইত্যাদি হচ্ছে মাইন্ড ট্র্যাপের উদাহরণ।
২। অশুভ সংকেত খুঁজে বেড়ানোঃ
– বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, যদি ইন্টারনেট স্লো থাকে কী হবে কাজের ! আজকেই যে কাজ ডেলিভারির শেষ দিন !
– মিটিং এ আব্দুল্লাহ ভাই থাকবে, খবর আছে !
– কাজের শুরুতেই এত বাধা আসতেছে, না জানি কি হয় !
– মিটিং দেরিতে শুরু হয়েছে, খুব খারাপ ইংগিত !
– সকাল সকাল এক শালিক দেখে ঘুম ভেঙ্গেছে, কী যে হবে !
– এই সপ্তাহ একটু কাজ করবো ভেবেছিলাম, এখনই ঠাণ্ডা লেগে গেলো , ধুর … !
…
ইত্যাদি ।
৩। অন্য মানুষের মনের কথা বুঝে ফেলার ভ্রান্তি
– সেলিম ভাই জানে, আমি একটা লুজার। ঐ প্রজেক্ট উনার সাথে করতে পারি নাই। আমাকে উনি আর কাজ দিবে না !
– মেয়েটা মনে হয় অন্য ছেলেকে ভালোবাসে, আমার কোনো চান্স নাই !
– ওরা জানে আমি ব্যাস্ত, তাই আমার আচরণে কষ্ট পাবে না !
– অমুক ভাই ঐ কথাটা কেনো বললো, নিশ্চয়ই উনি আমার ভালো চান না !
…
ইত্যাদি ।
৪। ওভার জেনারালাইজ করে কনক্লুশন-এ চলে যাওয়াঃ
– প্রেজেন্টেশন দিলাম, কেউ তো হাসলো না , নিশ্চয়ই সবাই আমার উপর আপসেট হয়ে গেছে
– খাবার সময় অমুক চুপচাপ থাকে, সে মনে হয় সবার দিকে খেয়াল রাখে বস কে কান পড়া দেয় !
– সে আমার কথাটা শুনলোই না ! খুব অহংকারী মানুষ !
– এত কম প্ল্যান করে কীভাবে ওরা এতো বড় সিদ্ধান্ত নিলো, সবগুলা গাধা !
… ইত্যাদি ।
৫। যে কোনো বিষয় কে অতিরিক্ত বড় করে দেখাঃ
– ছেলেটা বাংলায় এ প্লাস পায় নাই , ওর তো জীবন শেষ!
– ওরা ঝামেলা পাকাইছে, কাজের ১৪টা বাজিইয়ে দিয়েছে !
– বস যদি জানে আমি ইমোশনাল, তাহলে আমার ইমোশনের সুযোগ নিয়ে আমাকে দিয়ে বেশী কাজ করাবে!
– যেহেতু আমার মন নরম, তাই এগুলা ব্যাপার থেকে ১০০০ হাত দূরে থাকাই আমার উচিৎ !
– অমুক মামলা খেয়েছে, ও খুব খারাপ মানুষ, তা না হলে আর কেউ মামলা খায় !
… ইত্যাদি ।
মাইন্ড ট্র্যাপ বুঝার আরো অনেক ধরনের উদাহরণ দেয়া যাবে হয়তো, কিন্তু আমরা আসলে এখন আলোচনা করবো কীভাবে মাইন্ড ট্র্যাপ থেকে বের হয়ে আসা যায়।
মাইন্ড ট্র্যাপ থেকে বের হওয়ার দুইটাই মাত্র উপায় আছে । প্রথমটা হচ্ছে, গিভারস মেন্টালিটি। পৃথিবীতে শুধুমাত্র দুই ধরনের মানুষ পাওয়া যায়। একটা হচ্ছে গিভার, আরেকটা হচ্ছে টেকার। গিভার হচ্ছেন যিনি সব সময় আরেক জনের কীভাবে উন্নতি হবে সে যায়গায় জিরো নেগেটিভিটি ধারণ করে ১০০% পজেটিভ ভাবে এফোর্ট দিবে। কোনো প্রকার নেগেটিভ মাইন্ড সেট রাখাই যাবে না।
দ্বিতীয়টা হচ্ছে, নিজের জ্ঞান কে নতুন করে সাজানো-গোছানো। নিজের খারাপ অভিজ্ঞতা গুলো কেনো হয়েছে সেটা নিয়ে এনালাইসিস করে বুঝতে শেখা। এটাকে বলে কোগনেটিভ রি-ফ্রেমিং। আরো সরল ভাষায়, নিজেকে সবজান্তা না ভেবে বর্তমান জ্ঞান-বুদ্ধিটা কে একটু নাড়াচাড়া করতে হবে, ভুল গুলো এডজাষ্ট করতে হবে।
পরবর্তি পর্বে ইনশাল্লাহ আত্ম বিশ্বাস নষ্টের আরেক কারণ “ওয়াটার ট্রেডিং” নিয়ে আলোচনা করবো।
নোটঃ এটা কোনো সায়েন্টিফিক জার্নাল থেকে নেয়া নয়। কোনো একটা সাইকোলজিক্যাল লেখায় কথাগুলো পড়েছিলাম। তাই নিজের মতো করে বাংলা করে লিখে রাখলাম। যে কেউ চাইলে নিজের মতো গ্রহণও করতে পারেন, ফান হিসেবেও নিতে পারেন।